কাশ্মিরী ভাই
-অঞ্জনা গোড়িয়া
সেল সেল সেল। দারুন সুখবর।। মাত্র ১০০ টাকায় ঝকঝকে তকতকে নতুন শাল। মায়েরা বৌদিরা দিদিরা আর ঘুমিয়ে থাকবেন না। আসুন আসুন জলের দামে নিয়ে যান তুলতুলে শাল।
দূর থেকে শোনা যাচ্ছে এই ডাক। কাছে আসতে বুঝতে পারলাম মাইক বাজিয়ে হাঁক দিয়ে আসছে এক ফেরিওয়ালা। বাংলা তেমন জানে না সে। তাই রেকর্ড করা কথাগুলোয় বাজিয়ে চলেছে। কানে গেল বাড়ির বড়-বৌয়ের। ঘর থেকে বেরিয়ে এল। দেখল, ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে পাড়ার যত মেয়ে বউরা।
লাট দিয়ে সাজানো সুন্দর সুন্দর নক্সা করা কম্বল আর শাল। গোটা দশেক পাড়ার বউ শাল বাছাবাছি করছে। কেউ ঘরে নিয়ে গিয়ে দেখাচ্ছে, বাড়ির কর্তাকে। কেউ বা নিজ গায়ে পরে দেখছে, কেমন লাগে?
বছর সতেরোর বয়সের এক কাশ্মিরী যুবক। একা হিমসিম খেয়ে যাচ্ছে। তবু এক মুখ হাসি নিয়ে শাল বিক্রি করছে পাড়ায় পাড়ায়।
কাশ্মিরী শাল যেমন দেখতে সুন্দর তেমনই কম দাম। তাই ভিড় জমে গেল এক নিমেষে।
আধা আধা বাংলা বুলিতে বোঝানোর চেষ্টা করছে শালের দাম? মর্ত্যের বাসিন্দা আজ পেটের টানে পাহাড় থেকে নীচে নেমেছে মাটিতে। শাল দেখতে গিয়ে বারবার খুব জানতে ইচ্ছে করছিল বড় বৌয়ের। কেমন আছে ওরা ? নেট বন্ধ, মানে তো দম বন্ধ অবস্থা। খুব জানতে ইচ্ছে করল। খবরের কাগজ পড়ে নয়, শাল ব্যাপারীর মুখের কথা শুনে। সত্যিই কি ভালো আছে ওরা? কি করে দিন কাটছে ওদের?
পর্যটকদের ভিড় নেই স্বর্গে। অর্থনৈতিক অবস্থাও তাই শোচনীয়।
জানতে চাইল বড়বৌ, অত্যন্ত বিনয়ীর সঙ্গে। আপ লোক ক্যায়সা হো কাশ্মীরে?
শালব্যাপারী তার মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল। ধীরে ধীরে বলল, আপ কি রিপোর্টার? হাম নেহি বলেগা। শাল বেচে পেট ভরতা হ্যা হামারা। ওর কুছ নেহি বলেগা।
চোখের দিকে ভালো করে চেয়ে দেখল, চোখ দু’টো কেমন ছলছল করছে। কিছু কিছু কথা চোখের ভাষায় বুঝে নিতে হয়। সবাই শাল কিনতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। বেশ কিছু শাল বিক্রি হলো। কিন্তু যখন দাম হিসাব করল ব্যাপারী। দশটা শাল বিক্রি করে মাত্র আটটি শালের দাম পেল। কিছুতেই কেউ মানতে চাইল না, আমি নিয়েছি বলে।
বড় বৌ বারবার সবাইকে বলল, কে নিয়েছ স্বীকার করো। এভাবে চুপিচুপি নেওয়া অন্যায়। ওনারা এমনিতেই কত কষ্টে আছে। ফিরিয়ে দাও না হয় দাম দিয়ে দাও। বাঙালি ভাবতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। সত্যিটা স্বীকার করার সাহস নেই।
শাল ব্যাপারী কাঁদোকাঁদো স্বরে বলল প্লিজ রিটার্ন মি মাই শাল?
কেউ শুনল না। স্বীকার করল না সত্যিটা। বড় বৌ কিনে ছিল দু’টি শাল। তখনো হাতেই ছিল।
কি একটা ভেবে, বলল, ওয়েট প্লিজ। ঘরে গিয়ে চারটি শালের দাম নিয়ে এল। বলল স্যরি ভাই, মনে ছিল না কখন এ দু’টো শাল ঘরে এনেছিলাম। তুমি চারটি শালেরই দাম নাও।
কিছুতেই নিতে চাইল না। নেহি নেহি । আপ নেহি লি য়্যা।
হাতটা ধরে বলল, না হয় এক বাঙালি বোনের দেওয়া সামান্যটুকু উপহার স্বরূপ গ্রহণ করলে ভাই। রাখো। তোমার এই বাঙালি দিদির দেওয়া উপহার।
তৃপ্তির হাসি হেসে শাল গুছিয়ে ফিরে গেল দূর রাস্তায়। সামনে বছর আবার আসব দিদি। কাভি ভুল নেহি যায় এ। হাম তোমারা কাশ্মিরী ভাই ।